তবুও চলতে হয় সামনে…

 

জীবনের এ পথচলা যেন তিন প্রহরের যাত্রার মতো। প্রথম প্রভাতে জীবন সূর্যের কিরণ ততটা প্রখর থাকেনা; চারপাশের মানুষেরা বেশ ছাড় দেয়, দেয় সুযোগ। হাঁটা শেখানো, কথা বার্তা শেখানো,সাঁতার শেখানোর মতোই যেন তাদের সহায়তার ভাষা হয় “সামনের দিকে এগিয়ে চলো”.. পূর্বাহ্নে পৌঁছাতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হয় নানা সংকটের: অভাব, সাধনা, অধ্যবসায়.. যেন বন্ধুর পথে অনন্যোপায় যাত্রা।

মধ্যাহ্নে সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর থাকে, তখন ছাতা দেয়ার স্বজন খুব কমই থাকে। এতদিন যারা সামনে এগুবার প্রেরণা ছিলো, তাদের অনেকে ততদিন ওপারে চলে যায়। যে ক’জন থাকেন, তারা বড্ড ব্যস্ত; হয় নিজেকে নিয়ে, নয় নিজের অভাব সামলানোর কাজে। সুতরাং, একলা চলো রে…

চলার সুবিধার্থে বেশ কিছু মানুষ আমাদের খুব কাছের হয়, কিংবা কাছের ‘সাজে’.. বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে নিথর দরহ যাত্রা পথে বিশ্রামও চায়, চায় পানীয়ও। তবুও গন্তব্যে পৌঁছার আকাঙ্খা বা উচ্চাভিলাস থামতে দেয়না: জীবন তখন ঠাসা যৌবনের বাহন: এ পথব্রজক দৌড়ে যেন থামতেই চায় না! সে কী উদ্যম! সে কী উচ্ছাস! এ যাত্রায় অনেককে কাছে পাওয়া যায়, সত্য, তবে কেউ প্রিয়জন সাজে প্রয়োজনে, আর কেউ বা প্রয়োজনে সাধে প্রিয়জনেষুত্ব! কারো হাসি মেকি, কারো কান্না ভাবে, শটের বা অনুভবের! তবে দুরন্ত পথিক সেদিকে ভ্রুক্ষেপই যে করেনা! নিজের পাথেয় সাধ্যমতো সে বিলিয়ে দেয় সহযাত্রীদের। সে তখন ভাবে, এরাইতো শেষ গন্তব্য পর্যন্ত পাশে থাকবে! হায় irony!

বিকালে গড়িয়ে পড়লে সূর্যের আভার মতো হেলিয়ে পড়ে প্রাণশক্তি, এগিয়ে আসে পৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য। তখন দুরন্তপনা দূরত্বে চলে যায়, শারিরীক সামর্থের ক্ষয় দৃশ্যমান হয়, তবে দীর্ঘ যাত্রার ফলশ্রুতিতে বুদ্ধি, বিবেচনা, প্রগাঢ়তা বা গভীরতা পৌঁছে যায় পূর্ণাঙ্গতায়, পরিপূর্ণতার নাগপাশে। এ পথিক সঙ্গ চায়, পায় আশ্বাস। তেমন কেউ আর পাশে থাকেনা: পেছন ফিরে দীর্ঘ যাত্রা, দুর্গম পথ, ঘর্মাক্ত তৃষ্ণার কথা মনে পড়ে যায় পথিকের। সে ভাবে, এ দীর্ঘ হতাশ নিঃশ্বাসের জন্যইকি নিঃশ্বেষ করেছি এ প্রখর রৌদ্রতেজ, বা প্রভাত সৌন্দর্য? তার এ ভাবনার শেষ নেই, নেই সমাপ্তি, শুধু সমাপ্তি আছে বেলার: লাল সূর্য ঢলে পড়া দেখে বিষন্ন বিমর্ষ হয় পথিক। সর অনেক কিছু ভুলে যায়। যেন Shakespeare এর ভাষায় ফিরে পায়
“Second Childishness and mere oblivion”..
কেউ মনে রাখেনা তার অতীত।
Authority forgets a dying king”!

যে ভাবনায় পথিক একদা বিভোর ছিলো, সে আশা তার দীপ্ত মধ্যাহ্নে সূর্যাস্তের সময়কে ভুলিয়ে রেখেছে, সে ভাবনা নিরেট ভাবনা হয়েই ধরা দিলো। প্রায় সব সহযাত্রীর শটতা দেখে, অভিনয়ের হাসি দেখে পথিক বুঝে, বুঝে তাদের পরিণত অভিনয়। সব বুঝেও চুপ থাকার যে শিক্ষা দীর্ঘ যাত্রায় সে শিখেছে, সে শিক্ষাই তাকে বাকরুদ্ধ, নির্লিপ্ত করে রাখে। সে এবার ভাবে, সূর্যাস্তের পর আঁধার কালো রাতে কি পাথেয় সে পাবে সাথে? কেউ যখন হবেনা সহচর, কীভাবে তার কাটবে প্রহর?
এসব ভেবে আর কালক্ষেপণ করতে চায় না পথিক। তার মনে পড়ে যায়
কবি জালালুদ্দিন রুমির সে অমোঘ বাণীঃ
“এটা তোমার পথ, তোমার একার, অনেকেই তোমার সাথে হাঁটবে কিন্তু কেউ তোমার জন্য হাঁটবেনা”।

এসব ভাবনা ক্ষণে ক্ষণে মনোকষ্ট দেয় পথিককে, তবু সে ভাবে, যে যাত্রা গন্তব্যে পৌঁছাতেই হবে, সে ক্ষণে, এক্ষণে এত ভেবে লাভ কি?
সে কবিতাে মতো আওড়ায়ঃ
সকল ভাবনার সাঁঝক্ষণেও, দীর্ঘ গন্তব্যের এ যাত্রায়, আমাদের যেতে হবে, সবাইকেই মেনে নিতে হয় তবুও…

তবুও সামনে চলতে হয়…


বিচ্ছিন্ন ভাবনা
মোঃ নাজিম উদ্দিন
জুলাই ০২, ২০২১

লেখাটি লিখেছেন