পাছে লোকে কিছু বলে

Aug 5, 2021 | গল্প প্রবন্ধ উপন্যাস | 0 comments

পাছে লোকে কিছু বলে।

(১)

#ছোটবেলায় কবি কামিনী রায়েরর
“পাছে লোকে কিছু বলে” কবিতা পড়ানো হতো; অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝার বয়স তখন কী আর ছিলো? তবুও প্রাঞ্জল সহজবোধ্য ভাষায় লেখা কবিতাটির সহজেই কিছু ভাবার্থ অনুমেয় ছিলো। যখন ‘লাজ’ করা যাদের সাজে তারা ‘লাজ’কে বাজে ভেবে আজেবাজে কথায় ব্যস্ত থাকে। আর যাদের ‘সদা ভয়’ ‘সদা লাজ’-এর সাথে যুক্ত হয়ে কোন কাজ করা থেকে বিরত রাখে, তাদের জন্য লাজ করা সাজেনা।
#শিক্ষার্থিদের বলা হয়, না বুঝলে প্রশ্ন করবে- কিন্তু ছোটবেলায় আমার এ বদ অভ্যাসে অনেক কিছুই শিখতে পারিনি- বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাবনাটা ছিলো – “স্যার কি ভাববেন?” বা “সহপাঠিরা ভাববেন, আমি এত সহজ বিষয়ই জানিনা”। আর এখন খানিকটা বুঝি, এ অপ্রয়োজনীয় ‘লাজ’ কত ধ্বংসাত্মক ছিলো। তখন কী বুঝেছি- ‘জানার জন্য প্রশ্ন করা, না জেনে চুপ থাকার চেয়ে উত্তম’।
শুধু মুখস্থ করেছি- আত্মস্থ বা জীবনস্থ করতে পারিনি জীবনমুখী পংক্তিগুলো-
“করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে –
পাছে লোকে কিছু বলে।
আড়ালে আড়ালে থাকি
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
পাছে লোকে কিছু বলে।”

(২)

বয়স বাড়ার সাথে সাথে জানলাম- প্রয়োজনের বস্তুও চেয়ে নিতে হয়, কিন্তু সেখানেও ছিলো ‘লাজের সাজ’! ঠিক যেন কবিতার কথাগুলো:
“হৃদয়ে বুদবুদ মত
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি
সযতনে শুকায়ে রাখি;-
নিরমল নয়নের জলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।”

কিছু চেয়ে নিতে পারাও একটা বয়সের জন্য যোগ্যতা হয়তো। ‘রা কাঁদলে শিশু কিছুই পায়না’ – এটা শিশুর জন্য শুধু নয়, কিশোরের জন্যও সত্য।

(৩)

ছাত্রজীবন বলেন, কর্মজীবন বলেন, অতিরিক্ত লজ্জা শুধু যে অন্তর্মুখী করে দেয়, তা নয়, বরং তৈরি করে সংশয়, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি।

তবে irony.of fact হচ্ছে, এ লজ্জা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো কাজেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। খারাপ চিন্তা বা কাজ করার মানুষদের অভিধানে এসব লাজ বা লজ্জা নামক শব্দ পাওয়া যায় না!
কোন ভালো চিন্তা মাথায় আসলো, তৎক্ষণাৎ চিন্তা আসবে, লোক কী বলবে, তারা যদি বিছু মনে করে- ইত্যাদি। কবির ভাষায়-
“মহৎ উদ্দেশ্য যবে,
এক সাথে মিলে সবে,
পারি না মিলিতে সেই দলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।”

আর হয়তো এ জন্যেই, সমাজে খারাপ কাজের পরিমাণ যত বেশি, ভালো কাজের পরিমাণ তত বেশি নয়। নির্লজ্জ মানুষের উল্লফন যত বেশি, লাজুকদের ততটা নয়।

(৪)
#অপ্রয়োজনীয় ‘লাজ’ তৈরি করে দুর্বল চিত্তের মানুষ, বাড়ায় সন্দেহ আর অবিশ্বাস। যেমনটি বিখ্যাত নাট্যকার William Shakespeareও তার Measure for Measure নাটকের একাংশে বলেন,
“Our doubts are traitors,
and make us lose the good we oft might win,
by fearing to attempt.”
Our doubts are traitors,
and make us lose the good we oft might win,
by fearing to attempt.

ভালোকে ভালো আর খারাপকে খারাপ বলতে পারার অক্ষমতাও তৈরি হয় কিছুটা এই অযৌক্তিক লাজ বা লজ্জার কারণে।

(৫)

সামাজিক আচরণে, লোকে কী বলবে – এ ভাবনা প্রখর, প্রচন্ড শক্তিশালি। কী গ্রাম, কী শহরে, সামাজিক আচরণের বেশির ভাগ (কু)প্রথার উৎপত্তিস্থল কিন্তু “পাছে লোকে কিছু বলে”- নামক ভয় আর কৃত্রিম আন্তেকিতার শট বা নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ। আবার এ ‘লাজ’ তৈরি করে ‘না বলতে পারা’র অক্ষমতা, তৈরি করে নিজের মধ্যে সংশয় আর কমিয়ে দেয় আত্মবিশ্বাস। ফলে, যৌতুক বা সামাজিক অনাচারের অনেকাংশই যেখানে শিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে কমে যাওয়ার কথা ছিলো, তা বরং বেড়েছে! নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে অনেক পরিবার। মুখ বুঝে সামাজিক আর ধর্মীয় প্রথা বা আচারের কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে কুসংস্কারের যাঁতায় পিষ্ট হচ্ছে মুখ বুজে সহ্য করা বা “পাছে লোকে কিছু” বলবে -ভাবা লোকজন। ফলে বিস্তৃত হচ্ছে ‘ধারের অর্থনীতি’ আর বাড়ছে লোক দেখানো অনুষঙ্গ, যার কোন পরিসীমা নেই।

#শেষকথার কোন শেষ নেই। নিজের চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাই দূর করতে হলে নির্ভর করতে হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, নিজের র্আর্থিক সামর্থ্য আর সঠিক প্রয়োজনীয়তার উপর। যা পারবেন, তা-ই বলুন। যা পারবেন না, তা নয়। learn to say ‘no’ if you don’t want to say ‘yes’.


মোঃ নাজিম উদ্দিন
আগষ্ট ০৫, ২০২১

লেখাটি লিখেছেন