জীবনটা কতই না ছোট

Nov 19, 2020 | গল্প প্রবন্ধ উপন্যাস | 0 comments

জীবনটা কতই না ছোট!

(শিরোনামহীন বিচ্ছিন্ন ভাবনারাশি!):

——-

সেই ছোটবেলায় শীতের দুপুরে ঠান্ডা পানিতে গোসল করার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা গাঁয়ে বড় হওয়াদের থাকবেই; অনেকক্ষণ রোদে বসার পর পানি আরো ঠান্ডা লাগলে কেউ কেউ পানিতে নামার দীর্ঘসূত্রিতা কাটানোর জন্য পাশের জনকে বলতো ধাক্কা দিতে: ব্যস- পানিতে নামতে পারলেই হয়- বেশ কতক্ষণ গোসল করার সাহস থাকে, থাকতো।
আর এখন? পুকুরে কখন শীতকালে গোসল করেছি- সে স্মৃতি সুদূর!

গ্রীষ্মকালে সাঁতারের পর আবার সাঁতার-মনে হয় পুকুরে সাঁতার না কাটলে দুপুর/বিকাল পার হবে না! আর এখন? গ্রামে গেলেও পুকুরের সাথে কিয়দ আলিঙ্গনেরও সুযোগ কম!

গ্রামের বাদামতলের পাশে শীতের সকালে রোদ পোহানোর আগে কোথাও যাওয়াই হতো না; খড়কুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে উঞ্চতার পরশ লাগাতেই হত! বাড়ির পাশের বৈঠকখানায় সময় না কাটালে দিনটাই পার হতো না! আর আজ? বাদামতলও আছে, আছে বৈঠকখানাও, নেই সময়, সহচার্য!

“At my back, I always hear/ Time’s Wing’d chariot hurrying near”..

ডিসেম্বর-জানুয়ারীতে স্কুল ছুটির মজার সকাল, দুরন্ত দুপুর কিবা শ্রান্ত বিকেলে মাঠে না গেলে যেনো পেটের ভাত হজম হয় না কিশোরের! বাড়ন্ত যৌবনের পর সে  অন্তরঙ্গ মাঠে যাওয়ার সময় কই?

প্যারেডে বিকেলটা কাটানো, বা মশার কামড় ভুলে মাঠে বসে শিরোনামহীন আড্ডা কিবা চকবাজারের জয়নগর বা সাইমুনে সান্ধকালীন আড্ডা, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দি বা সবুর হলে বন্ধুদের সাথে ঘড়ি না দেখা সময় কি আর আসবে? অস্তিত্ববাদী বন্ধুগণ, কিংবা জিন্দা পীরের মাজার খ্যাত হোস্টেলে বন্ধু নাসিরের “সিরিয়াস” পড়াশুনা, “ধান্ধা তুমি” কবিতার বাংলা বিভাগে পড়ুয়া ছাত্র-চরিত্রের নিরব কান্নার কথা আজো কি কেই মনে রাখে, মোবারক? না, মোবারক এই নগরেই থাকেনা এখন: বান্দরবানের কলেজে অধ্যাপনায় ব্যতিব্যস্ত! ‘The world’s too much with us’!

ডিপার্টমেন্টের সব প্রোগ্রামের খরচ প্রমাণেে ভাউচারের কথা মনে আছে, সোলায়মান? না, সময় বড় ব্যস্ত, বন্ধু!

তেপান্তর মেসের ওসমান ভাইয়ের দেখা, বা তারেকদের সাথে গ্রুপ ডিসকাশনের সন্ধ্যা ছাড়া যাদের রাত আসতো না, কয়েকবছরেও সর মাঠ, হল বা মেসের আড্ডার সারথিদের সাথে দেখা হওয়ারই সময় কই? “The world’s too much with us..””

যে বাসায় ব্যাচেলর অবস্থায় ভাড়া থাকে চাকুরি প্রত্যাশী সদ্যপাশ যুবক, সে বাসার প্রতিটি স্মৃতি তার মনে থাকে, লবণ-মরিচের অসংলগ্ন মিশ্রণের রান্নায় ক্ষুধার্ত লাঞ্চে পর অগোছালো রান্নাঘর, মশারি না টাঙানো বেডরুমের দৃশ্য সে ভুলতে পারে না কিছুদিন! বাসা ছাড়ার সময় মনে হয়, কিছুদিন পর পর সেখানে স্মৃতির টানে যাওয়া হবে নিয়মিত, কিন্তু যুগ পেরিয়েও যাওয়া যায় কি?
যে কর্মস্থলে বছর-যুগ পার করে  “second home” বানায়, সে চাকুরে পরে কোনবার যেতে পারে সাবেক সে কর্মস্থলে? কর্মস্থল-পরিবারের সেসব সদস্যের দেখা বদলির পর মেলানো দেখা দায়! সময় বড় ব্যতিব্যস্ত! প্রিয় সহকর্মি পুলক দা, নুর উদ্দিন ভাই বা আদনানরা ইতিমধ্যেই ইহলোক থেকে সময়ের আগেই যেন চিরঅবসরে! ‘How time does fly!’

আর্য, পাল, সেন, মোগল ব্রিটিশ বা রোম, অটোমান- কত শাসনামল, কত নবাব আজ ইতিহাস! কত সাম্রাজ্য আজ চারণভূমি, কত সম্রাট-উত্তরসুরী আজ মঞ্চ থেকে চরণে – সময়, তুমি কখন কার??
‘ Time is an old gypsy man”…

“Life’s but a walking shadow”…
আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো? কতজনের সাথেই একবার দেখা হওয়ার পর আর দ্বিতীয়বার দেখা হয়নি জীবনে, তার তালিকা কত দীর্ঘ, জানেন?
নোটপ্যাডে সেইভ করা লেখনি, ব্রিটিশ কাউন্সিল, বই মেলা বা বাতিঘর থেকে কত রেফারেন্স বই কিংবা জীবনি গ্রন্থ কিনে এনে মনে হয় রাতেই শেষ করে ফেলব, কিন্তু শেষ করা যায় নি অনেক বই। সব বই কি শেষ করা যায়? তার পরও নতুন বই কিনি পড়ার আশায়, অপেক্ষায়! কত বইয়ের “ক্রেতা” পাঠক হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে অকালে!
২০০৫-২০০৬ সালের টিউশন মাষ্টারের ছাত্র এখন পুরোদস্তুর চিকিৎসক! ইনডিপেন্ডেন্ট স্কুলে ক্লাস ফোর এ পড়তো Ahnaf- গত সপ্তাহে নিজের কর্মস্থল আগ্রাবাদে দেখা: সে এনএসইউ থেকে বিবিএ শেষ করে এখন একটা ফরেন ব্যাংকের অফিসার! তার ছোটবেলার ইমেইজ ভেসে আসতে লাগলো যখন সে সেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কঠিন নিয়ম এখনো মেনে ইংরেজিতে কথোপকথনের অভ্যাস চালু রাখলো তার স্যারের সাথে!

বছরটা এসেছে যেন সেদিন, কত সি,এল, ই,এল বা এস,এল রয়েই গেলো, কোন পলকে শেষ কর্মদিবস চলেই গেলো, বুঝার উপায় নেই। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, পৌঢ়ত্ব এভাবে পলকেই নিঃশেষ হয়ে যায়-কত to do list অসমাপ্ত থেকে যায় কাল করছি ভেবে রাখলেও!
“A Brief History of Time” যেন মহাকালের কৃঞ্চগহবরে ঢুকে যাওয়া ছোট এ ভবশহরের প্রতি ঠাট্টা!
মহাকাল সময়ের অস্তিত্বের বিপরীতে অনন্ত কালের তুলনায় নিমিষ-মুহুর্তের এ ভবলোকে জন্মের সময় দেয়া আজানের নামাজ হয় জানাজার নামাজে। মাঝখানের এক পলকের এ আয়ুষ্কালে কত কিছু করার ইচ্ছে থাকলেও করা হয়ে উঠে না!

এক ন্যানোসেকেন্ড থেকে যাত্রা শুরু সে আয়ুষ্কালের ডেডলাইন যখন জানাই নেই, তখন দ্রুত, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ শেষ করতে পারাই অর্জন।
সেদিনের “বর্তমান” কখন যে “অতীত” হয়ে গেলো, কখনই বা দূরে মনে হওয়া ভবিষৎ চোখের সামনে “আজ” হয়ে ধরা দিল কিছু বুঝার আগেই – তা দেখে বিস্ময়ে জাগার সময়ও বা কই!
চট্টগ্রাম কলেজের প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ নাজিম উদ্দিন স্যার তাঁর এক শিক্ষকের বুড়িয়ে যাওয়া নিয়ে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি এভাবে বুড়ো হয়ে গিয়েছেন কেন? স্যারের উত্তরটা ছিল: ‘Grapes turn to raisin after ages’! আসলেই, সুন্দর আঙুরও বয়োকালে কিসমিসে পরিণত হয়!

সমস্ত “আগামী” বর্তমান হওয়ার প্রস্তুতিতেই কত দ্রুত “অতীত” হওয়ার যাত্রা শুরু করে “অতি সংক্ষিপ্ত ” এ জীবনে- যার যবনিকাপাত-            very unpredictable, very startling…

মোঃ নাজিম উদ্দিন

লেখাটি লিখেছেন