আমার ‘গালিবল’ দাদী

সাদাকালো টিভি তখনো বেশি প্রচলিত হয়ে উঠেনি গ্রামে, অন্তত আমাদের গ্রামে। গ্রাম তথা রাউজানের মোহাম্মদপুরে ১৫/২০ পরিবারের স্বচ্ছল ১ বা ২ টি পরিবারে টেলিভিশন ছিল। আমরাও প্রতিবেশির ঘরে গিয়ে টেলিভিশন দেখতাম।

তেমন একদিনের ঘটনা। রাত নয়টা। ধারাবাহিক নাটক চলছে। বিটিভিতে। এক পর্যায়ে এক দৃশ্যে চরিত্র হিসেবে আবুল হায়াতের আগমন। তৎক্ষণাৎ দাদীর সজোরে জিজ্ঞাসা : ” এই লোক সেদিন আরেকটা নাটকে মারা গিয়েছিলো না?” সম্ভবত ধারাবাহিক নাটক “অয়োময়” এ আবুল হায়াত (নাট্য নাম সম্ভবত।রফিক) শেষাংশে মারা যান। আর দাদী এতটাই সহজে বিশ্বাস করেছিলেন যে, সেদিন সে চরিত্রের মানুষই মারা গিয়েছিলেন!!

উল্লেখ্য, ‘অয়োময়ে’ রফিক চরিত্রের আবুল হায়াত মারা যাওয়ার পর দাদীর সে কী অশ্রুজল! যেন সত্যিই কোন স্বজনের সত্যিকারের মৃত্যু হয়েছে!
এটা ছিল সম্ভবত ১৯৯০ এর দশক।

এরও কিছুদিন আগে রঙিন টিভিতে প্রথম কিছু দেখা নিয়ে রয়েছে আরেক উপাখ্যান! ঘটনাটা অবশ্য শুনে জেনেছি! পোর্ট কলোনি। বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দর অফিসার্স কোয়ার্টার। দাদী মরহুম ছফুরা খাতুনের কনিষ্ট ভ্রাতা মরহুম এম, এ, সালাম দাদা চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত ছিলেন বিধায় সপরিবারে থাকতেন ‘পোর্ট কলোনি’তে । দাদী বেড়াতে যেতেন সেখানে।

সম্ভবত ১৯৮০’র দশক। দেশে রঙিন টিভি এসেছে তার কিছুদিন আগে। সৌখিন দাদা পোর্ট কলোনির বাসায় নতুন রঙিন টিভি কিনেন। এক রাতে সবাই মিলে টিভিতে এক নাটক দেখছিলো রঙিন মাঝারি সাইজের টিভিতে। টিভি চলছে। হঠাৎ কৌতুহলী দাদীর প্রশ্ন: ‘এ বক্সের ভেতর কিভাবে মানুষ ঢুকেছে?’ দাদীর ভাইপোরাও ছিলেন ভারী দুষ্টু: বললেন, এ বক্সের পেছন দিয়ে তারা ঢুকে এবার অভিনয় করছে! দাদী সহজাত স্বভাবে চলে গেলেন টিভির ঠিক পেছনে: শুধালেন: কই, এখানে তো কোন খালি জায়গা নেই কেউ ঢুকার!’ হায় রে ‘গালিবল’!!

দাদীর সহজ সরলতার আরেকটি ঘটনাঃ দাদীর শাশুড়ি দাদীর উপর কোন কারণে রাগান্বিত হলেন। রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দাদীকে বললেন, ” আমার ছেলে এবার দেশে (চাকুরি থেকে ছুটিতে) আসুক: তোমাকে তোমার বাপের ঘরে পাঠিয়ে দিবো”। এ কথা সহজেই বিশ্বাস করে ফেললেন দাদী ছফুরা খাতুন। বাবার বাড়ি আর শশ্বর বাড়ি একই হওয়াতে এক সুবিধাও ছিল তার। শাশুড়ির হুমকি শুনে বিয়ের কয়েকটি শাড়ি (যা তখনকার দুর্মূল্যের যুগে দামী সম্পদ ছিল) লুকিয়ে সালাম দাদী তথা মরহুম নুরজাহানকে হাতে দিয়ে বলেন, “আমাকে নাকি তোমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিবে: যদি আসার সময় এসব দামি শাড়ি যদি আনতে না পারি, তাই নিয়ে আসলাম”- এমন কথা শুনে দাদীর শাশুড়ির উপর রাগ হওয়ার পরিবর্তে দাদীর কথায় অট্টহাসি দিলেন মরহুম নুরজাহান বেগম।

পুলিশ কনস্টেবল দাদা মরহুম আহমদুর রহমান ছিলেন দাদীর ঠিক উল্টো! প্র্যাকটিক্যাল বা বাস্তববাদী, চৌকষ ও বুদ্ধিমান। দাদীর এ ধরণের বোকামী আর সহজে বিশ্বাস করা নিয়ে দাদার কাছ থেকে কত বকাই না শুনতেন!

তেমনই একদিনের ঘটনা । প্রতিদান সকালে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের এক প্রতিবেশির ঘরে জোরে সাউন্ড করে ট্যাপ রেকর্ডারে ওয়াজ মাহফিলের ক্যাসেট চালু করা হতো। প্রায় সময় কোন কাজ করতে করতে দাদী সে সব ওয়াজ শুনতেন। একদিন কোন কারণে সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। এতে মনোযোগী শ্রোতা দাদীর আক্ষেপ: ‘আজ এদের ঘরে ওয়াজ হচ্ছে না কেন?” দাদীর এমন প্রশ্নে এতদিন ধরে একই ক্যাসেট ওলট পালট করে দিতে থাকা মাহফিলের অডিও শুনতে শুনতে অনেকটা বিরক্ত দাদার রাগান্বিত প্রতুত্তুর ছিল অরেকটা এমন: “প্রতিদিন একই ক্যাসেট ভাল্লাগেনা”!..

এভাবে অতি “গালিবল” (gullible) দাদীর জীবনের ঘটনাবহুল জীবন সম্বন্ধে যা জেনেছি, সেসব তথ্যের অন্যতম অতি সাধারণতা আর সরলতা। সহজে সব কথা বিশ্বাস করা যেন নিজের ধ্যান ধারণায় গ্রত্থিত থাকতো। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ যুগে এমন সরলতা যেন অতি ‘বোকামি’ই ঠেকবে।


মোঃ নাজিম উদ্দিন
অক্টোবর ১৯, ২০২০

লেখাটি লিখেছেন